অনলাইন ডেক্সঃ
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যানোরেক্সিয়া বলতে মূলত আমরা খাবারের চাহিদা কমে যাওয়ার একটি বিশেষ পর্যায়কে বুঝি। যেমন অনেকের বিভিন্ন অসুখ হলে খাবারের চাহিদা কমে যায় যাকে মেডিক্যালের ভাষায় অ্যানোরেক্সিয়া বলে। অন্যান্য রোগের কারণে যদি সাময়িকভাবে খাবার গ্রহণ করার চাহিদা কমে যায় তবে এই কন্ডিশনকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। এটি কয়েক দিন পর ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যদি অ্যানোরেক্সিয়ার কারণে দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালোরি নেওয়া দরকার তা বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এটা অবশ্যই রোগ বলে বিবেচিত হবে।
এবার আসি মূল আলোচনায়, ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ হচ্ছে খাদ্যাভ্যাসজনিত এক প্রকার মানসিক রোগ। যে রোগের মূল কারণ রোগীর অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা। তার মধ্যে এমন একটি চিন্তাভাবনার জগত তৈরি হয় যে সে মনে করতে থাকে খাবার খেলেই তার ওজন বেড়ে যাবে এবং তাকে দেখতে বাজে দেখাবে সেই সাথে মনে করে সে সামাজিকভাবে অন্যদের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হবে। এ রকম চিন্তাভাবনার কারণে যদি কারো খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসে এবং সে যদি দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালোরি নেওয়া দরকার সেটা থেকে বিরত থাকে কিংবা উপবাস থাকা শুরু করে তখন এই অবস্থাকে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা বলা হয়ে থাকে।
কারণ
এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর বিভিন্ন কারণ গবেষণার মাধ্যমে বের করতে পেরেছেন। তার মধ্যে কিছু বিশেষ কারণ তুলে ধরছি।
- অ্যানোরেক্সিয়ার বায়োলজিক্যাল কিছু কারণ রয়েছে। যেমন কারো জেনেটিক সমস্যা থাকতে পারে। যার কারণে তার ক্ষিধে লাগবে না এবং সে খাবার এড়িয়ে চলবে। তবে একরম কেসের অনুপাত খুব কম দেখা যায়।
- অনেকের ক্ষেত্রে নিজেদের চারপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নিজেকে চিকন রাখার প্রবণতা গড়ে উঠে এবংসে খাবার কম খায়। এতে করে এক সময় তার অ্যানোরেক্সিয়া ডেভেলপ করতে পারে।
- কেউ কেউ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডির কারণে কিংবা কোনো হতাশা বা বিষাদগ্রস্ততার কারণে খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। সে নিজেকে স্বাস্থ্যবান মনে করে এবং সে নিজে মনে করে যে খাবার না খেলে তার ডিপ্রেশন কমে যাবে। এই চিন্তা থেকে সে খায় না। তখন তা পর্যায়ক্রমে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসাতে রূপ নেয়।
- আবার কেউ কেউ এমন আছে যে, সে হয়তো কখনো ওভার ওয়েট হয়ে গিয়েছিলো অথবা তার ওবেসিটি ডেভেলপ করেছিলো যার কারণে সে হয়তো সামাজিক বুলির স্বীকার হচ্ছিলো এবং সে ওজন কমাতে চাইলো। তখন ওজন কমাতে গিয়ে সে মানসিকভাবে স্থির করলো যে সে খাবার কম খাবে এবং কম খেতে খেতে এক সময় তার মধ্যে অবসেসিভ চিন্তা চলে আসে। একদম কম খেয়েও ভালো থাকা যায় এরকম মনে করে সে খুব দ্রুত নিজের ওজন কমানোর জন্য নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। দেখা যায়, একসময় তার আর ক্ষিদে লাগে না, সে খাবার খায় না। এইভাবে কারো কারো ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ খাবার বন্ধ করে কেবল পানি পান করে জীবন ধারণের প্রবণতা চলে আসে এবং সে তাই করে। এতে করে তার শরীর কোনও পুষ্টি পায় না এবং এক সময় এটা লাইফ থ্রেটেনিং কন্ডিশনে রূপ নেয়। এই ধরনের অবস্থাকেই বলা হয়ে থাকে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার উপসর্গ
অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীরা নিজেদের স্বভাব এবং চালচলন অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। যদিও প্রচুর শারীরিক এবং আচরণগত পরিবর্তন তারা লুকাতে পারেন না।
শারীরিক পরিবর্তন যেমন-
- অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া এবং তাদের দেখলে ভীষণ রোগাক্রান্ত মনে হয়।
- কারো সামনে খেতে বসে না। খেলেও নানা ধরনের টালবাহানা করে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কিংবা খুব অল্প পরিমাণে খেয়ে উঠে যায়।
- একটা সময় আসে তারা খাবার গ্রহণ পরিপূর্ণ বন্ধ করে দেয় এবং খাবার গ্রহণ না করলেও তার জীবন স্বাভাবিক এমন একটা ভাব দেখায়।
- যখন শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, তখন তারা নিজেদের রোগ বুঝতে পারে। তবে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হয় না।
- খাবার গ্রহণ না করার কারণে তাদের সারাক্ষণ মাথা ঘোরা (ভার্টিগো) থাকে এবং অতিরিক্ত ক্লান্ত লাগে।
- অকারণে শীত শীত অনুভব হয়।
- চুল পড়ে যায়।
- শরীরের চামড়া শুকিয়ে যায়।
- মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুচক্র বা বন্ধ হয়ে যায়।
তাদের মধ্যে কিছু আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-
- তাদের মধ্যে ওজন বেড়ে যাওয়া এবং খাদ্যে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। যার কারণে ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে নিয়মিত খাবার খায় না এবং বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে এবং ওভার ওয়েট হয়ে যাচ্ছে কিনা সেজন্য বারবার ওজন মাপতে থাকে।
- দুই দিন না খেয়ে থাকলেও তারা খিদে নেই বা খেয়ে নিয়েছি বলে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবেরকে খাবারের সময় এড়িয়ে চলে।
- তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সোস্যাল এনক্সাইটি অথবা ফোবিয়া ডেভেলপ হয়।
- ওজন কমাতে তারা অতিরিক্ত ব্যায়াম করে। দেখা যায় তারা ১০০০ ক্যালোরি পরিমাণ খাবার খেলে এই পরিমাণ ব্যায়াম করে যেন তাদের ১২০০ ক্যালোরি এনার্জি লস হয়। এইভাবে দিন দিন তারা রোগাক্রান্ত হতে থাকে।
অ্যানোরেক্সিয়ার চিকিৎসা
অ্যানোরেক্সিয়া যদিও মানসিক রোগ তথাপি যেহেতু এই রোগের প্রভাব শরীর ও মন উভয়ের ওপরেই পড়ে তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও নানান রকমের হয়। অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীরা না খেয়ে থাকার কারণে অপুষ্টিতে ভোগেন। তাই তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে যদি ওজন স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও চিকিৎসা করানো যেতে পারে।
মেডিসিন এবং সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা করানো দরকার হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট কিংবা নিউরোলজিস্ট এর পরামর্শ নিতে হতে পারে। চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রথমেই যা করতে হয় তা হচ্ছে রোগীর নিউট্রিশন ঠিক করা, মুখে না খেলে শিরা পথে সাপ্লিমেন্ট এর মাধ্যমে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সাপ্লাই দেওয়া হতে পারে।
এইভাবে পর্যায়ক্রমে তাদেরকে খাবারের জন্য কাউন্সেলিং করা। যাতে তাদের খাদ্যাভ্যাস ফিরে আসে। এজন্য তাদেরকে যৌক্তিকভাবে খাবারের পুষ্টি জ্ঞান দেওয়া যাতে খাবার গ্রহণের উপকার এবং খাবার বর্জণের ক্ষতিকর দিক তারা বুঝতে পারে। এজন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট বা সাইকোথেরাপিস্টদের সহযোগিতা নিতে হতে পারে।
ওজন বেড়ে যাওয়ার যে ভয় তৈরি হয়, তা দূর করতে সঠিকভাবে তাদেরকে বিহেভিয়ার থেরাপি দেওয়া, সঠিকভাবে কাউন্সেলিং করা। এই ক্ষেত্রে রোগীর পরিবারের লোকজনের সাপোর্ট, সহপাঠীদের আন্তরিক সাপোর্ট এবং স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষকদের আন্তরিক মানসিক সাপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা একটা জীবন বিনাশী রোগ। কারণ এই রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক অবস্থায় রোগী নিজে কিংবা পরিবারের কেউই তা বুঝতে পারে না। যেহেতু এটা মানসিক রোগ তাই রোগী যখন এটা বুঝতে পারে তখন সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে রোগী এটার চিকিৎসা করতেও রাজি হয় না। আপনার পরিচিত কারোর মধ্যে যদি অ্যানোরেক্সিয়ার উপসর্গ দেখতে পান, তবে সবার আগে তাদের চিকিৎসা করাতে রাজি করাতে হবে। যেহেতু তারা নিজেদের রোগকে রোগ হিসাবে বলতে রাজি হয় না, তাই আপনাকে খুব আন্তরিক হয়ে ধৈর্য্য সহকারে তাদেরকে তাদের রোগ সম্পর্কে বোঝাতে হবে। খাবার গ্রহণের জন্য তাদের সাথে জোর করে তেমন একটা লাভ হয় না কারণ জোর করে খাওয়ানো হলেও তারা পরে বমি করে তা বের করে ফেলে। তাই তাদেরকে খাবারের জন্য জোর করা যাবে না। যদি পরিবারের কোনও সদস্য এনোরেক্সিয়াতে ভোগে তবে পরিবারের বাকি সদস্যরা যাতে নরমাল খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার। এতে করে তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে কিংবা ডাক্তার অথবা সাইকোলোজিস্টগণ তখন পরিবারের অন্য সদস্যদের খাবার গ্রহণকে তার সামনে উপমা দিয়ে তাকে সঠিক ভাবে কাউন্সেলিং করতে পারবে।
সেলফ কাউন্সেলিং
কেউ যদি বুঝতে পারে যে সে অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত, তখন তার নিজের উচিৎ পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তা শেয়ার করা এবং এর যৌক্তিক সমাধান বের করা। কিংবা ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার ভয়ে খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেওয়ার কারণে যাদের মধ্যে অ্যানোরেক্সিয়া ডেভেলপ করেছে তাদের উচিৎ এই ক্যালরি ও ওজন বৃদ্ধি নিয়ে পড়াশোনা করা এবং এই বিষয় সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। এতে কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করলে ওজন বৃদ্ধি পাবে না এমন একটা আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে তৈরি হবে এবং সে অ্যানোরেক্সিয়া থেকে সহজেই বের হয়ে আসতে পারবে আশা করা যায়।
সবচেয়ে ভালো হয় একজন ডাক্তার এবং ডায়েটিসিয়ানের সাথে পরামর্শ করে একটা সঠিক লাইফস্টাইল ফলো করা। যাতে করে একটা সুস্বাস্থ্য সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়।
চিকিৎসা না করালে যে সব জটিলতা হতে পারে
না খেতে খেতে রোগীর মধ্যে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। যেমন অ্যানিমিয়া বা রক্তশুন্যতা, হার্টে মাইটাল ভালব প্রলাপ্স হতে পারে, ইলেক্ট্রোলাইট এর ভারসাম্যহীনতা, কিডনির জটিলতাসহ নানাবিধ হরমোনাল সমস্যা হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসা করা অপরিহার্য।