অনলাইন ডেস্ক:
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশ তখন এক ক্রান্তিকাল পার করছিল। স্বল্প আয়ের অধিকাংশ মানুষ কর্মহীন। সারাদেশে হতদরিদ্রদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারিভাবে শুরু হয়েছিল ত্রাণ কার্যক্রম। ঠিক তখনই কিছু সুযোগসন্ধানী ও লোভী জনপ্রতিনিধি হতদরিদ্রের ত্রাণ আত্মসাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। দেশের সেই দুর্দিনে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ত্রাণ আত্মসাতের মতো জঘন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলেছিলেন, এই মহাদুর্যোগের সময়ে সরকারের ত্রাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। ওইসব সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে কমিশনের কর্মকর্তাদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
ওই নির্দেশ পাওয়ার পরই ঢাকাসহ সারাদেশে দুদক কর্মকর্তারা ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। লকডাউনের কঠিন সময়ে জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করেছেন তারা। চাল ও গম আত্মসাৎকারী জনপ্রতিনিধি, সংশ্নিষ্ট কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। দুদকের হস্তক্ষেপে একপর্যায়ে ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
দুদকের এই কার্যক্রম নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে সমকাল। করোনার মহাদুর্যোগে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। তিনি বলেন, লকডাউনের কঠিন সময়ে জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে করোনায় দুদকের তিনজনের মৃত্যু এবং ৬০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনা আক্রমণের ভয়াবহ দিনগুলোতে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে করোনা রোগীদের সেবা করছিলেন। সে সময় কিছুসংখ্যক বাড়ির মালিক করোনার তথাকথিত ভীতির দোহাই দিয়ে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। ওই সময় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, দেশের এই সংকটকালে জনসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ কিংবা কোনো প্রকার অসম্মান আইনত অপরাধ। সেটা আইনগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে। প্রয়োজনে দুদক ওই মালিকদের বাড়ি নির্মাণের অর্থের উৎস খুঁজবে। অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কমিশনের এই হুঙ্কারে তখন ওইসব মালিক সংযত হয়েছিলেন।
এরপর দুদক কভিড-১৯-এর চিকিৎসায় নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয় এবং বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এ ক্ষেত্রে দুদক প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে মামলাও করেছে। এ সম্পর্কিত আরও অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে।
সমকালকে দেওয়া দুদক চেয়ারম্যানের পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো :
সমকাল: করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের অভিযান পরিচালনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
ইকবাল মাহমুদ: দেখুন, করোনা দুদকের তিনজন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার শুরুতেই আক্রান্ত হয়ে দুদকের প্রশাসন অনুবিভাগের পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। মেধাবী এই তরুণ কর্মকর্তার মৃত্যুতে আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময় কর্মহীন হতদরিদ্র মানুষের ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিয়েছিল কমিশন। পরে ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনা দুদকের নজরে আসে। লকডাউনের এমন কঠিন সময়ের মধ্যে দুদক সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি মামলা করে। বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে ওইসব মামলার অনুমোদন দেয় কমিশন। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমরা ধন্যবাদ জানাই। কারণ, তারা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।
সমকাল: করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আপনারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ইকবাল মাহমুদ: দেশকে সেবার দুটি দিক রয়েছে। করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে দেশের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলসভাবে সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে স্বাস্থ্য খাতের কিছু ব্যক্তি প্রতারণা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। করোনাকালে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের ফলাফলের ভিত্তিতে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। দেখুন, দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা প্রায় অসম্ভব, তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কমিশন এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আগেই চিন্তা করেছিল। ঠিক সে কারণেই ২০১৭ সালে দুদক স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছিল। ২০১৯ সালের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ১১টি উৎস এবং তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান হস্তান্তর করেন। প্রতিবেদনে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়, সরবরাহ, বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন, মেডিকেল কলেজ স্থাপন, নিয়োগ, বদলি, চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিংসহ অধিকাংশ ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
সমকাল: যখন করোনার ভয়াবহ প্রকোপ ছিল, তখন কমিশন কীভাবে সভা করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
ইকবাল মাহমুদ: করোনার তীব্র সংক্রমণের দিনগুলোতে আমরা ভার্চুয়াল সভা করতাম। এ প্রক্রিয়ায় সবাই আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতাম। আমরা সার্বিকভাবে বিষয়গুলো তদারকি করতাম। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের চ্যানেল উন্মুক্ত রেখেছিলাম। আসলে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাশক্তিই বড় কথা।
সমকাল: করোনাকালে জনগণের সেবার পরিবর্তে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
ইকবাল মাহমুদ: করোনার সময় কেন? অনেক আগেই আমরা বলেছি, অবৈধ সম্পদ ভোগ করার সব পথ রুদ্ধ করা হবে। আপনারা দেখেছেন অসংখ্য ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ কমিশন আইনি প্রক্রিয়ায় জব্দ করেছে। শুধু ২০১৯ সালেই প্রায় ৫২৩ কোটি টাকার সম্পদ সিজ (জব্দ) করা হয়েছে। কনফিসকেট (বাজেয়াপ্ত) করা হয়েছে ৪৩৬ কোটি টাকার সম্পদ। অর্থাৎ অবৈধ সম্পদ উপভোগ করার সব পথ পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হচ্ছে।
সমকাল: যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন- তাদের জন্য কমিশন কী করছে?
ইকবাল মাহমুদ: আমাদের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কমিশনের যোগাযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি, তাদের পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের কল্যাণে যা যা করণীয়, বিদ্যমান বিধিবিধানের মধ্য থেকে কমিশন তা করবে।
সমকাল: দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনায় আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।
ইকবাল মাহমুদ: লকডাউনের দিনগুলোতে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে কমিশন প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। কমিশনের অধিকাংশ সভা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে করা হয়। এ ছাড়া কমিশন ই-নথি চালু করেছে। সে সময়ে অধিকাংশ সিদ্ধান্তই ই-নথিতে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। করোনার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশন আইনি দায়িত্ব পালন করেছে। দুর্যোগের দিনেও নিখুঁতভাবে দুর্নীতি শনাক্তকরণ, তদন্ত ও প্রসিকিউশনের মাধ্যমে অপরাধীদের আইন আমলে আনার দায়িত্ব কমিশন সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করেছে।
সমকাল: আপনি অবগত আছেন যে, নকল ও অবৈধ পণ্যের বিরুদ্ধে সমকাল একটি প্রচারাভিযান শুরু করেছে। নকল পণ্য উৎপাদনকারী ও অবৈধ পণ্য বাজারজাতকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দুদকের আলাদা কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
ইকবাল মাহমুদ: নকল ও অবৈধ পণ্যের পেছনেও দুর্নীতি রয়েছে। নকল ও অবৈধ পণ্য নিয়ন্ত্রণে যাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাদের হয়তো সক্ষমতার ঘাটতি আছে। নকল ও অবৈধ পণ্যের বিরুদ্ধে সমকাল যে প্রচারাভিযান শুরু করেছে, কমিশনের পক্ষ থেকে এই অভিযানকে স্বাগত জানাই। আর দুর্নীতি যেখানেই হোক বা দুর্নীতির সঙ্গে যারাই সম্পৃক্ত থাকুক না কেন, তা দুদকের নজরে এলে সংশ্নিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না।