রাজশাহী নিউজ টুডে ডেস্ক:
দেড় বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী কমিটি, সারা দেশে পুনর্গঠনের কাজ শুরু ডিসেম্বরের মধ্যে দল গোছানোর চিন্তা, নির্বাচিত কমিটি করতে তৃণমূলের চাপ বাড়ছে
আগামী মার্চে দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে দল গোছানোর কাজ শুরু হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই বিএনপির সাংগঠনিক ৮২ জেলা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে।
আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে অঙ্গ-সংগঠনের পাশাপাশি মূল দল গোছানো শেষ করতে চায় দলটি। এরপর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন বছরের মার্চে কাউন্সিল করা হবে। এর আগে দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে বিএনপি।
জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বেগম জিয়ার স্থায়ী মুক্তির প্রক্রিয়াও চলবে। দলের নেতা-কর্মীরা মুক্ত খালেদা জিয়াকে নিয়ে কাউন্সিল করতে চায়। তবে দলের একটি সূত্র এও বলছে, আগামী বছরের মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন করবে সরকার। বিএনপিও পৃথকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছরের পূর্তি পালন করতে চায়।
সে কারণে মার্চ মাসে বিএনপির কাউন্সিল না হয়ে এপ্রিলে বা পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে হতে পারে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। তিন বছর পরপর দলীয় কাউন্সিল করার গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গত বছরের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা, করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তো কাউন্সিলের উদ্দেশ্যে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাস সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো করোনা শেষ হয়নি। এখন আমাদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা।
এরপর সময় সুযোগ হলে দলের কাউন্সিল হবে। কিন্তু এ মুহূর্তে কাউন্সিলের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। অঙ্গ সংগঠন পুনর্গঠন হচ্ছে। বিএনপির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটি হবে। এরপর যথাসময়ে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। ’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে থানা-পৌর-ইউনিয়নসহ সব পর্যায়ের কমিটির হালনাগাদ তথ্য চেয়ে জেলা নেতাদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ দিকে শীত মৌসুমে করোনার প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে। এ জন্য আসছে শীত মৌসুমটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। আর দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না কমলেও বিএনপি পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে কাউন্সিল করবে। তবে কাউন্সিল করতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক চাপ রয়েছে।
জানা যায়, আগামীর কাউন্সিলে বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। সাবেক ছাত্রনেতাদের দেখা যাবে বিভিন্ন পদে। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের ঠাঁই করে দেওয়া হবে। কারাগারে যাওয়ার আগে বেগম জিয়া সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির সভায় বলেছিলেন, আগামীতে সব কমিটিতেই তরুণদের জায়গা করে দেওয়া হবে। বিএনপি নেতা-কর্মীরাও বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অপেক্ষাকৃত তরুণ। তার চিন্তা চেতনাও অনেকটা তরুণ নেতাদের নিয়ে। তবে বিএনপির কেউ কেউ বলছেন, সামনের কমিটি হবে নবীন-প্রবীণ সমন্বয়ে। এক্ষেত্রে কাউন্সিলে বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। সুবিধাভোগী ও সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলা নেতাদের রাখা হবে পেছনের সারিতে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জাতীয় কাউন্সিলের আগে প্রতিটি জেলা, উপজেলা বা থানার সব ইউনিট সম্পন্ন করতে হয়, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তবে বৈশ্বিক ও বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, আগামীর কাউন্সিলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির আকার ছোট হতে পারে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মনোভাব হচ্ছে, ছোট আকারের ‘শক্তিশালী’ নির্বাহী কমিটি। বর্তমান কমিটির মতো ‘ঢাউস’ কমিটি করা হবে না। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা সমালোচনা হয়েছে। অনেক অযোগ্যরাও কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। সেখানে সর্বোচ্চ ২৫১ বা ২৭১ সদস্যের নির্বাহী কমিটি করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিকসহ সব সম্পাদকীয় পদের সংখ্যাও কমতে পারে।
দলীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার বেশিরভাগের পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলেও সেগুলোর মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। মাদারীপুর জেলা কমিটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। রাজশাহী মহানগর, বরিশাল মহানগর, পটুয়াখালীসহ বেশ কিছু জেলা শাখা বহু আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কমিটি গঠন করতে পারেনি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির মধ্যে গাজীপুর, লালমনিরহাট, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, মেহেরপুর, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, শেরপুর জেলা কমিটির মেয়াদ থাকা অবস্থায় আবারও পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে।
জানা যায়, দল পুনর্গঠন নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা হলো, মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটি গঠনে ৩ মাসের জন্য প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি করা হবে। তারা ইউনিয়ন-থানাসহ সংশ্লিষ্ট জেলার সব পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে অথবা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। সব শেষে জেলা কাউন্সিল করে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জানা যায়, অনেক জেলার নেতারা ইতিমধ্যে কেন্দ্রের নির্দেশনা মেনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব পর্যায়ের কমিটি গঠন করে ফেলেছেন। তবে নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফরিদপুর জেলায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির জেলা কমিটি নেই। এগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আগামী মাসেই ঘোষণা করা হতে পারে।
সূত্রে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন কমিটি দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা সব বিভাগ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের মৌখিকভাবে নির্দেশনাও দিয়েছেন। ফলে তারাও সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, করোনা মহামারীর কারণে প্রায় ৬ মাস কমিটি গঠন ও পুনর্গঠনসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আবার শুরু হয়েছে। প্রস্তুতির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পরই জাতীয় কাউন্সিলের আয়োজন করা হবে। আর সেক্ষেত্রে প্রধান প্রস্তুতিটাই হলো জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের তালিকা প্রস্তুত করা। সেটি যতক্ষণ পর্যন্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের কাউন্সিল আয়োজন করা সম্ভব নয়।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, করোনার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর তা আবার শুরু হয়েছে। কমিটি পুনর্গঠন কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। যথাসময়ে এই পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে জাতীয় কাউন্সিলের আয়োজন করা সম্ভব হবে।